প্রিয় নবী (সা.) সর্ব দিক দিয়ে উত্তম আদর্শ। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম অনুপম আদর্শ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)
মহানবী (সা.)-এর বাণীসমূহ ও কার্যাবলি উভয়ই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়। তবে কিছু কাজ তাঁর জন্য খাছ (বিশেষ), তা উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়। মহানবী (সা.) সব কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন। সদা রোজা রাখতেন না, আবার সারা রাত জেগে ইবাদতও করতেন না। রোজা রাখতেন আবার ভঙ্গ করতেন, রাতে ইবাদত করতেন আবার নিদ্রাও যেতেন।
রাতের ইবাদত : মহানবী (সা.) রাতকে ইবাদতের মুখ্য সময় মনে করতেন। রাতের প্রথম ভাগে নিদ্রা যেতেন। অবশিষ্ট রাত ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। তাহাজ্জুদের নামাজ তাঁর ওপর ফরজ ছিল। ফলে শেষ রাতে ঘুম থেকে ওঠা বাদ যায়নি। রাতে তিনি কত রাকাত নামাজ পড়তেন এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। জায়েদ ইবনে খালেদ আল জুহানি (রা.) বলেন, আমি একবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে আজ রাতে রাসুল (সা.)-এর রাতের নামাজের প্রতি লক্ষ রাখব। অতঃপর আমি দেখলাম যে তিনি ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক ও অজু করে সংক্ষিপ্ত দুই রাকাত নামাজ পড়েন। তারপর দীর্ঘায়িত করে দুই রাকাত নামাজ পড়েন। তারপর আরো দুই রাকাত নামাজ পড়েন, এ দুই রাকাত আগের দুই রাকাতের চেয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেন। অতঃপর আরো দুই রাকাত নামাজ পড়েন, এ দুই রাকাত ছিল আগের দুই রাকাতের চেয়েও সংক্ষিপ্ত। তারপর আরো দুই রাকাত নামাজ পড়েন, তা ছিল আগের দুই রাকাতের চেয়ে সংক্ষিপ্ত। অতঃপর বিতর নামাজ পড়েন। সর্বমোট নামাজ পড়েছেন ১৩ রাকাত। (মুসলিম, মুয়াত্তা ও আবু দাউদ)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতের নামাজ কখনো ৯ রাকাত পড়তেন, কখনো ১১ রাকাত, কখনো ১৩ রাকাত পড়তেন, তন্মধ্যে বিতর নামাজও থাকত। তিনি মাঝেমধ্যে রাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। আবার মাঝেমধ্যে দীর্ঘ সময় বসেও নামাজ পড়তেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে কিরাত পাঠ করতেন, তখন রুকু-সিজদাও বসে করতেন। আর যখন ঊষার আবির্ভাব হতো তখন তিনি ফজরের দুই রাকাত সুন্নত পড়তেন। অতঃপর মসজিদের উদ্দেশে বের হতেন এবং লোকদের ফজরের নামাজ পড়াতেন। (মুসলিম)
মুগিরা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) রাতের নামাজে এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে তাঁর কদম মোবারক ফুলে যেত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে আপনি এমন কেন করেন, অথচ আপনার অতীতের ও ভবিষ্যতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হয়েছে। তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন, আমি কি কৃতজ্ঞশীল বান্দা হব না? (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে দাউদ (আ.)-এর ইবাদত অধিক পছন্দনীয়, তিনি অর্ধরজনী নিদ্রা যেতেন এবং রজনীর এক-তৃতীয়াংশ নামাজে থাকতেন। আর কখনো রাতের এক-ষষ্ঠাংশ নিদ্রা যেতেন। একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন রাখতেন না। (বুখারি ও মুসলিম)
রাতের দোয়া কবুল হয় : আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোন দোয়া অধিক শ্রবণ করা হয়? প্রত্যুত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, শেষ রাতের দোয়া এবং ফরজ নামাজের পরের দোয়া। (তিরমিজি)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমাদের কল্যাণময় সুউচ্চ মর্যাদাবান প্রভু প্রত্যেক রজনীতে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হন, যখন রজনীর শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তিনি বলতে থাকেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দান করব এবং কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারি ও মুসলিম)
তাহাজ্জুদ সর্বোত্তম নফল নামাজ : আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন, ‘রাতে তাহাজ্জুদ পড়ুন। এটি আপনার জন্য অতিরিক্ত (নফল) হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯)। আল্লাহর এ আদেশ যদিও রাসুল (সা.)-এর জন্য, তথাপি সাধারণ মুমিনরা যেহেতু রাসুল (সা.)-এর অনুকরণের জন্য আদিষ্ট, সেহেতু তারাও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত। সালমান ফারসি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা রাতে নামাজ পড়ো। কেননা এটা তোমাদের পূর্ববর্তী মহৎ ব্যক্তিদের রীতি। কেননা রাতের নামাজ তোমাদেরকে তোমাদের রবের নিকটবর্তী করে, গুনাহসমূহ মোচন করে, পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং শরীর থেকে রোগ বিতাড়িত করে। সাহল ইবন সাদ (রা.) বলেন, জিবরাঈল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেছেন, হে মুহাম্মদ! জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা তার রাতের নামাজে। (ফিকহুস সুন্নাহ-কিয়ামুল লাইল পরিচ্ছেদ)।
লেখক : প্রধান ফকিহ
আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী |