মৃত্যুর অপেক্ষা অনাহারে না করোনায়


করোনাভাইরাস যখন প্রথমবারের মতো দেশে পৌঁছে যায় তখন লাতিন আমেরিকার দেশ হাইতি কর্তৃপক্ষ এবং দেশটির মানবিক বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কিত হয়ে যান। তাদের এই আশঙ্কার নেপথ্যে দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কিন্তু সেই আশঙ্কাকেও ছাপিয়ে যায় মহামারির অর্থনৈতিক পরিণতি; যা দেশের দরিদ্রদের জন্য করোনার চেয়েও ভয়াবহ প্রাণঘাতী রূপে হাজির হয়েছে।

শনিবার পর্যন্ত মাত্র আটজনের মৃত্যু নিয়ে কোভিড-১৯ মহামারি দেশটিতে এখনও প্রকোপ শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নিয়ম অনেকের কাছে অসাধ্য বিলাসিতার মতো; যেখানে অসংখ্য মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতের ওপর নির্ভর করে দিনে এনে দিনেই খেয়ে বেঁচে থাকেন।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের প্রচেষ্টা হিসাবে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত দেশ হাইতির ক্ষমতাসীন সরকার আগামী ১১ মে থেকে জনসম্মুখে মাস্ক পরা প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে।

মাস্ক দূরের বিষয়, অনেক হাইতিয়ান এখন প্রশ্ন তুলেছেন : আজ না খেয়ে মরবো নাকি কাল করোনায়?

পেশনভিল শহরের পোর্ট-অ-প্রিন্সের পূর্বদিকের পাহাড়ি এলাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম সপ্তাহে তিনদিন সীমাবদ্ধ রাখার বিধি-নিষেধ চালুর বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এই এলাকার একটি টাউন হলকে কেন্দ্র করে এই নির্দেশনা জারি করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়েছে।

গত ১৯ মার্চ করোনা রোগী পাওয়া গেছে বলে ঘোষণা দেয়ার পর দেশটিতে আতঙ্কিত হয়ে লোকজনের কেনাকাটা বেড়ে যায়। এখন অনেকেই সাধ্যের বাইরে গিয়েও বেশি পরিমাণে কেনাকাটা করছেন। এর ফলে দেশটিতে পণ্য-সামগ্রীর দাম আকাশচুম্বী। গত বছরের এই সময়ে চালের দাম যা ছিল; বর্তমানে তা দেশটির কিছু কিছু বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

গত মার্চ থেকেই দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়েছে। করোনা মহামারির আতঙ্কে আমেরিকার এই দেশটিতে দেড় বছর আগে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল; সেটি ফেরার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনলাইনে বার্ষিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে হাইতির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুথে বলেছেন, ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের কারণে আমাদের অর্থনীতি প্রায় চার শতাংশ সঙ্কুচিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি

হাইতির অর্থনীতিবিদ এতজার এমিলি বলছেন, দেশের নাগরিকদের অর্ধেকই কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট; যদিও মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাতের অবদান মাত্র ২১ শতাংশ।

দরিদ্র শ্রমিক, যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারের মালিক তাদের আয় চলতি মৌসুমে কমে গেছে। তাদের জন্য পরবর্তী মৌসুমের ফসল চাষের প্রস্তুতিগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। খরার কারণে ইতোমধ্যে কিছু কিছু অঞ্চলে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার অনেক আগে থেকেই জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে আসছে যে, চলতি বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ হাইতিয়ানের জরুরি মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।

এতসংখ্যক মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার বিষয়টি একটি দেশকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর ইঙ্গিত বলে সতর্ক করে দেয় জাতিসংঘ। সংস্থাটি জানায়, মার্চের শুরুতেই হাইতির প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারাত্মক খাদ্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়বেন।

প্রবাসী হাইতিয়ানরা প্রত্যেক বছর কোটি কোটি ডলার পাঠিয়ে দেশকে গভীর দারিদ্র থেকে রক্ষা করে আসছেন। বিদেশে থাকা দেশটির নাগরিকরা প্রত্যেক বছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেন; যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

দেশটির অর্থনীতিবিদ কেসনার ফ্যারেল বলেন, হাইতিয়ানরা খাবার, শিক্ষা এমনকি শেষকৃত্যের জন্যও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করেন। দেশটির অধিকাংশ প্রবাসীই বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে; বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির এই দেশটিতে করোনার ভয়াবহ প্রকোপে বেকারত্ব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, সঙ্কটে পড়েছেন হাইতিয়ানরাও।

হাইতির অর্থ মন্ত্রণালয় এক পূর্বাভাষে বলেছে, আগামী মাসে দেশের রেমিট্যান্সের পরিমাণ এক চতুর্থাংশ হ্রাস পেতে পারে।

ফ্যারেল বলেন, আমরা বলতে চাই, আমেরিকানরা যখন ফ্লুতে ভোগেন, হাইতি তখন নিউমোনিয়ায় ভোগে। যুক্তরাষ্ট্রে যদি লাখ লাখ প্রবাসী চাকরি হারান তাহলে আমাদের দেশে নিশ্চিতভাবে চরম দারিদ্র নেমে আসবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *