কাতারে কাজ হারিয়ে বেদিশা বাংলাদেশিরা, খাবার শেষের পথে


করোনা হানা দিয়েছে কাতারেও। বেড়েই চলছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। পরীক্ষা করা হচ্ছে এমন প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের শরীরে ধরা পড়ছে করোনা। করোনার এমন পরিস্থিতিতে দেশটির সবকিছুই যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। এমন বিপর্যয়ে ক্ষুধা নিবারণে প্রবাসী শ্রমিকরা ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশি শ্রমিকরাও পড়েছেন অর্থ সঙ্কটে।

গার্ডিয়ানের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ২০ জন প্রবাসী শ্রমিক নিজেদের অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। এসময় তারা মানসিক খারাপ অবস্থা, হতাশা ও ভয় প্রকাশ করেন। তাদের অনেকেই বলছেন, হঠাৎ করেই তারা যেন বেকার হয়ে পড়েছেন। জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো উপায়ও নেই। অনেকেই বলছেন, তারা বাড়ি ফিরতে মরিয়া, তবে তা সম্ভব নয়। কেউ কেউ তাদের নিয়োগকর্তা বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে খাবারের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ আবার খাবার জোগানোর জন্য ভিক্ষাও করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে সেদেশে কাজ করতে যাওয়া এক পরিষ্কারকর্মী গত মার্চ মাসে চাকরি হারিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার কাছে খুব বেশি খাবার বাকি নেই। শুধু কিছু চাল ও মসুর ডাল আছে। এগুলো দিয়ে কয়েকদিন চলবে। কিন্তু এই খাবারগুলো শেষ হলে কী হবে আমার?

কাতারে ২ মিলিয়নেরও বেশি প্রবাসীকর্মী রয়েছেন। দেশটি এখনো বিশ্বে মাথাপিছু সংক্রমণের সর্বোচ্চ হারের মধ্যে একটি। মাত্র ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার করোনা রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রায় সব রোগীর অবস্থাই হালকা। গুরুতর নয়। মৃত্যুর হারও খুব কম। মাত্র ১২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

মধ্য এপ্রিলে সরকারি এক নির্দেশনায় দেশটিতে জীবিকার জন্য ব্যয় আরো বাড়ানো হয়েছে। করোনাভাইরাসের জন্য বিধিনিষেধের কারণে শ্রমিকদের অবৈতনিক ছুটিতে ফেলে দেওয়া বা চুক্তি সমাপ্ত করতে পেরেছিল এমন সংস্থাগুলোকে আরো প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সরকার বলেছে, খাদ্য ও আবাসন, যা সাধারণত নিয়োগকর্তারা ব্যবস্থা করেন, তা অবশ্যই সরবরাহ করা উচিত।

দু’মাস আগে কাতারে চাকরি করতে যাওয়া এক ফিলিপিনো বিউটিশিয়ান জানিয়েছেন, তিনি মাত্র অর্ধমাসের বেতন পেয়েছিলেন। এখন তাকে চাকরি থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমার বস বলেছেন, তার কাছে কোনো অর্থ নেই। ফিলিপাইনে আমার পরিবার কি খাবে? তারা আমার পাঠানো অর্থে জীবন নির্বাহ করে। এখন আমি কিভাবে খাবার পাব? আমাকে খাবার দেওয়ার কেউ নেই।

করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন অননুমোদিত শ্রমিকরা। যারা সাধারণত ‘ফ্রি ভিসা’য় কাজ করতে গেছেন। তারা স্বল্পমেয়াদী বা নৈমিত্তিক কাজের ওপর নির্ভর করে অর্থ পেয়ে থাকেন। আর বর্তমানে তারা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে।

কাতারে ফ্রি ভিসায় ডেকরেটরের কাজ করতে যাওয়া এক বাংলাদেশি জানান, মার্চের মাঝামাঝি থেকে তার কাছে কোনো কাজ নেই। তিনি বলেন, আমার সব অর্থ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে কোনো অর্থ নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থ ধার করে চলছি। এখানে কাজ না করে টিকে থাকা খুব কঠিন। আমি করোনাকে ভয় পাই না। কিন্তু সমস্যা হলো এখানে কোনো কাজ নেই।

নেপাল থেকে কাতারে যাওয়া একদল গৃহকর্মী পড়েছেন বড় বিপাকে। তারা ভাইরাস এবং নির্যাতনের ভয়ে রয়েছেন। গল্ফ উপসাগরীয় অঞ্চলে নির্যাতনের দৃশ্যটা অনেক পুরনো। এক নারী গৃহকর্মী বলেন, আমাদের কাছে এখন আর কোনো অর্থ নেই। আমরা আমাদের সুপারভাইজারের কাছে খাবার চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের কিছু দিয়েছেন। তবে এটি শেষ হলে কী হবে?

বুধবার দেশটির সরকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া, দোহার উপকণ্ঠে বিশাল শ্রমশিবির, কল-কারখানা এবং গুদামগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে। যার বেশিরভাগ মার্চ মাসে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পরে পুরো লকডাউন হয়েছে। দেশটির সরকার বিভিন্ন সংস্থাগুলোর জন্য ছয়শ ৫৬ মিলিয়ন পাউেন্ডের ঋণ প্রকল্প চালু করেছে; যাতে কর্মীদের বেতন প্রদান অব্যাহত রাখতে পারে, তবে শিল্পাঞ্চলের কিছু কর্মী গার্ডিয়ানকে বলেছেন যে তাদের বিনা বেতনে ছুটিতে রাখা হয়েছে।

প্রায় দুই মাস ধরে শিল্পাঞ্চলে আটকা পড়ে থাকা ভারতীয় এক কর্মী বলেন, আমাদের সংস্থা বলছে তারা এপ্রিল মাসের জন্য আমাদের বেতন দেবে না। তবে তারা আমাদের খাবারের জন্য কিছু অর্থ দেবে। কিন্তু আমরা তা পাইনি। কিছু দিন আগে তারা আমাদের কিছু ডিম এবং তেল দিয়েছে। আমরা এখানে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। কারাগারে আটকে থাকার মতো অবস্থা।

তবে সরকার বলছে তাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। গত মাসে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের পণ্য বোঝাই করা এক হাজার ট্রাক প্রতিদিন শিল্পাঞ্চলে ঢুকেছে। শ্রমিকদের জন্য খাদ্য, পানি ও সুরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে ওই ট্রাকগুলো পাঠানো হয়। কিন্তু গার্ডিয়ানের রিপোর্ট বলছে অন্য কথা। তারা খাবার সঙ্কটে ভুগছেন।

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একটি জোট এপ্রিল মাসে উপসাগরীয় দেশগুলোর সরকারগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, স্বল্প বেতনের অভিবাসীকর্মীরা করোনা সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *