গ্রাহকের টাকা আত্মসাতে ব্যাংকের কর্মকর্তারাই


বাংলা সংবাদ ডেস্কঃসাতক্ষীরার হরিশ্চন্দ্রকাঠির বাসিন্দা কৃষক মণ্ডল দেশের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ১০ বছর মেয়াদি একটি সঞ্চয় স্কিম খোলেন। স্কিমটির মেয়াদ পূর্তির পর পেশায় দিনমজুর এই গ্রাহক টাকা তুলতে গেলে তাঁকে জানানো হয়, তাঁর সঞ্চয় হিসাবের বিপরীতে ৮০ হাজার টাকার একটি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এটা শুনে তিনি রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যান এবং তাত্ক্ষণিকভাবে বিষয়টি অস্বীকার করেন। কারণ ঋণ আবেদনের ফরমে থাকা স্বাক্ষরের সঙ্গে তাঁর স্বাক্ষরের কোনো মিলই নেই। তার পরও তাঁকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক। অবশেষে তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণের দায় থেকে অব্যাহতির পাশাপাশি সঞ্চয়ের টাকা ফেরত পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে মণ্ডল নয়, ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জালিয়াতির মাধ্যমে তাঁর হিসাব থেকে ওই টাকা তুলে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের সম্প্রতি প্রকাশিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে গ্রাহকের হিসাব থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ আত্মসাতের এমন কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যাংক কর্মকর্তারাই অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ গ্রাহকের চেক জালিয়াতি করে, কেউ গ্রাহকের নামে ঋণ সৃষ্টি করে, আবার কেউ গ্রাহকের জমানো টাকার মুনাফা বা সুদ তাঁদের হিসাবে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করছেন। শাখা ব্যবস্থাপকরাই এ কাজে বেশি জড়াচ্ছেন। সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক নারীসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আটকও করেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক অবক্ষয় বা লোভ-লালসার কারণে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এটা প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে মাঝেমধ্যেই ব্যাংক বা গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করার কথা আমরা শুনতে পাই। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও ব্যর্থতা আছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যাঁরা জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা কেন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না সেটা বের করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুধু বললেই হবে না, যাঁরা দায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুধু অবক্ষয় নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার অভাবেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি রয়েছে। ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাই জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাঁদের শাস্তি না দিলে অন্যরাও এ কাজে উৎসাহিত হবে।’ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠিক করা না গেলে এ ধরনের সমস্যার সমাধান হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

গ্রাহকদের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সিলভিয়া আক্তার রিনি নামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাকে দুদকের মামলায় জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ওই কর্মকর্তা ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ব্যাংকের সঞ্চয়পত্রসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের ৪৫৪টি লেনদেনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সুদের মোট চার কোটি ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার ৫২০ টাকা নগদ ও নিজের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।

৫১ জন গ্রাহকের স্বাক্ষর নকল ও জাল-জালিয়াতি করে গ্রাহকদের অনুকূলে ঋণের টাকা বিতরণ না করে প্রায় ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে। গত ১৫ জানুয়ারি মো. নূর নবী চৌধুরী নামের এই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে নোয়াখালী দুদক কার্যালয়। ব্যাংকটির সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা শাখায় ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত থাকাকালে অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাংক হচ্ছে মানুষের আস্থার জায়গা। কিন্তু ব্যাংকের কর্মকর্তারাই যদি এভাবে টাকা আত্মসাৎ করেন তাহলে মানুষের আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে এগুলোকে শক্ত হাতে দমন করা।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গ্রাহকদের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ২৮ মার্চ। এরপর থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ৩৪ হাজার ৬৭৮টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কেবল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৪৯৯টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় পাঁচ হাজার ৪৯৩টি। ছয়টি অভিযোগ অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। ওই অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে সাধারণ ব্যাংকিংবিষয়ক এক হাজার ৫৯৩টি। এ ছাড়া গ্রাহক সেবায় অসন্তুষ্টি ৩১৩টি, চেক জালিয়াতি ২৬টি, রেমিট্যান্সসংক্রান্ত ৭১টি, এটিএম ও ক্রেডিট কার্ডবিষয়ক ৪৮৩টি এবং মোবাইল ব্যাংকিং ১২৩টি অভিযোগ পড়ে। বাকিগুলো অন্যান্য অভিযোগ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *