পৃথিবীর হুমকি মাটি দূষণ


পৃথিবীর ভূত্বকের কঠিন-নরম দানাদার আবরণ হলো মাটি। এ মাটির ওপরই পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহে মানুষের বসবাস। মাটির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আকাশচুম্বী পাহাড়-পর্বত, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত্র, নদীর স্রোতধারা, সর্বোপরি সবকিছু। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে মানুষ মাটিরই সন্তান। মাটির ওপরই মানুষের জীবন-জীবিকা। আবার জীবনলীলা সাঙ্গ শেষে এ মাটির বুকে চিরকালের আশ্রয়। মাটির ওপর কত অত্যাচার করা হয়, ক্ষতবিক্ষত করা হয় মাটির দেহ। তবু মাটি কোনো প্রতিবাদ করে না। সবকিছু নীরবে সয়ে যায়। যদিও এ মাটিকে নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তা করি না। অন্যসব দূষণ নিয়ে চিন্তা করলেও মাটি দূষণ নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব, জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ, নানাবিধ দূষণ, কৃষির অপরিকল্পিত নিবিড়করণ, উচ্চফলনশীল নানা শস্যের চাষ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মাটি দূষণ ঘটছে ও মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবসভ্যতা আজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। মানুষের নানা কর্মকা-েই মাটি বিষাক্ত ও অনুর্বর হয়ে পড়ায় তা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি তৈরি করছে। আমাদের মৌলিক চাহিদার প্রতিটি উপাদানই কোনো না কোনোভাবে মাটির সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৯৬ শতাংশ খাদ্যই মাটি থেকে পাওয়া য়ায়। এক তথ্য মতে, পৃথিবীতে বছরে প্রায় সোয়া কোটি হেক্টর জমির অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ মাটি অবক্ষয়জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। মাটি পরিবেশের অন্যতম উপাদান এবং প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের মূল ভিত্তি। মাটি জীববৈচিত্র্যের আধার, পানি বিশোধনকারী ও জমাকারী। মাটি খাদ্য তৈরির মূল ভিত্তি ও উদ্ভিদের পুষ্টির জোগানদাতা। মাটি কার্বন গ্রহণকারী ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থা উপশমে সাহায্যকারী। সর্বোপরি মাটি সম্ভাবনার ভা-ার ও মাটির বুকে সমগ্র প্রাণিকুলের বসবাস।

পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই মাটির অবক্ষয় ও মাটি দূষণ রোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে তা সমগ্র মানবজাতির জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। বাংলাদেশের মাটিও ভালো নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। মাটির অতিরিক্ত ব্যবহার, দূষণ, লবণাক্ততার প্রভাব, অপরিকল্পিত শস্য আবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। এক তথ্য মতে, লবণাক্ততার কারণে ১৮ জেলার ৯৩ উপজেলার ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমির মাটি কমবেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। জৈব উপাদানের ঘাটতি ধরা পড়েছে প্রায় ৫২ লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে। প্রতি বছর জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে, বিপরীতভাবে একটু একটু করে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। জমির জৈব পদার্থই মাটির প্রাণ। এটি গাছের পুষ্টি ধরে রাখা, পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, বায়ু চলাচল বৃদ্ধি ও মাটির নিবিড়তা বৃদ্ধি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সার্বিক মাটি ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটিতে জৈব সার রিসাইক্লিং হচ্ছে না। অনেক সময় দেখা যায়, কৃষিজমিতে অনুমাননির্ভরভাবে সার প্রয়োগ করা হয়। ফলে অতিরিক্ত সার প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ পরিবেশ বিপর্যয় ত্বরান্বিত করে থাকে। তাই প্রকৃতি বুঝে জমির উর্বরতা রক্ষায় কৃষককে আরও সচেতন হতে হবে। কৃষি কর্মকা- যেন মাটি, পানি ও ফসলের বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট না করে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর দিতে হবে।
ইটভাটায় ইট তৈরিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে মাটির ওপরের স্তর নষ্ট করা হচ্ছে। জুম চাষ ও মাটি কাটার কারণে ভূমিধস হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়ার কারণে মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, বোরন ইত্যাদি পদার্থ সঠিক মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। উপকূলীয় মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন কষ্টসাধ্য, ব্যয় সাপেক্ষ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসংঘ মাটি দূষণকে ‘গুপ্তঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাটির দূষণ ও ক্ষয় বাড়তে থাকলে তা সার্বিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার সঙ্গে মাটির নিরাপত্তাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বিদেশি গাছের (আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস) পরিবর্তে মাটিতে দেশি গাছের চারা রোপণ করতে হবে। জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব জৈব সার ব্যবহারে জোর দিতে হবে। মাটিকে প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। জেগে ওঠা চরের উর্বর মাটিকে কাজে লাগাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ বর্তমান বাস্তবতায় মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর নজর না দিলে তা মানবসভ্যতার ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।

হসাধন সরকার,শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *