১১ জুন, রোববার। বাদ আসর। উপস্থিত, অনুপস্হিত লাখো মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রাব্বে কায়েনাতের দরবারে হাজিরা দিলেন আমাদের প্রিয় রাহবার ‘শুক্কুর ছাব ‘।
ঐতিহাসিক ফুলতলী মাদরাসা মাঠে জানাযা শেষে ঐ মাদরাসার উত্তর পাশে অবস্থিত পারিবারিক করবস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দ্বীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ খাদিম। আমাদের বিশ্বাস, প্রায় ৬০/৭০ বছর ক্বোরআন- সুন্নাহ, মসজিদ- মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত এমন মকবুল মানুষ পরপারে মহান মালিকের করুনার ফল্গুধারায় সিক্ত হবেন। জান্নাতী মেহমান হিসেবে আখেরাতের অনন্ত জিন্দেগী অতিবাহিত করবেন। আমীন।।
২.
১৯৯৮-৯৯ সালের মাহে রমদ্বানে ‘ফুলতলী’তে দারুল ক্বিরাত পড়তে গিয়ে তাঁকে হুজুর (উস্তাদ) হিসেবে পেয়েছিলাম। প্রায় প্রতিদিন জোহরের পূর্বে তাজবীদ ক্লাস শেষেই আমরা হুজুরকে ঘিরে ধরতাম। ঘিরে ধরার কারণ হলো, ক্বোরআন তেলাওতের বিভিন্ন জটিল পদ্ধতি ও কঠিনতর তাজবীদের নিয়মাবলী জানার আগ্রহে। হুজুর হাসিমুখে সকলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এমনও হয়েছে, আমরা প্রশ্ন করতে করতে দলবেঁধে তাঁর বাড়ি (পুরান বাড়ি) পর্যন্ত গিয়েছি। তাঁর কথামালা, বাচনভঙ্গি আমাদের মোহিত করতো। স্নেহে সিক্ত হতাম।
৩.
আমি ঐ সেশনে সকল শিক্ষার্থীদের খেদমত করার উদ্দেশ্য গঠিত পরিষদের সহকারী ‘নাজিম’ ছিলাম। ছিলাম তালামীয পরিষদের মনোনীত ‘জি.এস’। এ সুবাদে ও তাসনীমে ক্বোরআন সম্পাদনার কাজে তাঁর সাহচর্য লাভ করতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিলাম। ছাত্রদের প্রতি হুজুর বা শিক্ষকদের যে অফুরান মায়া ও দরদ থাকতে হয় তা কিছুটা হলেও তাঁর কাছ থেকে শিখতে পেরেছিলাম। শিক্ষকতা পেশায় এসে এমনতর উপলব্দি ও গুণ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। ফলও পেয়েছি হাতেনাতে।
৪.
হুজুর বৃহত্তর সিলেটের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মেহমান হিসেবে ওয়াজে যেতেন। সিলেটি ভাষায় দরদ নিয়ে বয়ান করতেন। মানুষ পেতো সত্য ও সুন্দরের আলো। একবার আমাদের বড়লেখার কোন এক প্রান্তিক জনপদে এলেন। আয়োজকরা না বুঝে কিছু ‘অসংগতি ‘ করে ফেললেন। হুজুর তাঁর পি.এসকে বললেন, ‘মাষ্টর বেটারে ফোন লাগাও’। পি.এস ঘটনা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি উদ্দ্যোগ নিলাম। পরের সপ্তাহে আয়োজকরা হুজুরের বাড়িতে গেলেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইলেন। হুজুর হাসিমুখে তাঁদের আপ্যায়ন করালেন। সব ঠিক হলো। আমি মানসিকভাবে শান্তি পেলাম।
৫.
১৭/১৮ সালের দিকে হুজুর আমাদের এলাকায় আসলেন। আমার গরীবালয়ে হুজুরকে চায়ের ‘দাওয়াত’ দিতেই তিঁনি কবুল করলেন। এলেন। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে আমাদের ধন্য করলেন। দোয়া করলেন। আমার মরহুম পিতার কবরও জিয়ারত করলেন।
দেখা আরও হয়েছে। কিন্তু তাঁর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ আর হয়নি। তবে সেদিন (১১ জুলাই’২১) আসর আর মাগরিবের মাঝামাঝি তাঁর কবরের অদূরে দাঁড়িয়ে কিছু না বলা কথা আমি বললাম। আমার বিশ্বাস, তাঁর রুহ অধমের কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। কারণ মুমিনের ‘রুহ’ মরণের পরে আরও শক্তিশালী হয়।
৬.
তাঁর অসংখ্য পরিচয় ছিলো। এরমধ্যে সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিঁনি শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এর ভাতিজা। হুজুর এ পরিচয়টি দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমরাও এ পরিচয় প্রচার করে তৃপ্তি পেতাম।
তাঁর এ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও আমাদের এ তৃপ্তি যেন মহান মালিকের দরবারে কবুল হয়। সালেহীনদের পথে যেন আমরা থাকতে পারি। চলতে ও বলতে পারি। ছুম্মা আমীন।।
••••••••••••••••
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
গাজিটেকা, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।
লেখক: শিক্ষক ও সংগঠক