২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রর ওপর হামলা চালানো হয়। জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়দা চারটি বিমান ছিনতাই করে যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত কিছু দালানের ওপর সেগুলোকে মিসাইল হিসেবে ব্যবহার করে।
এ হামলায় প্রায় ৩,০০০ মানুষ এতে মারা যায়। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে ‘ওয়ার অন টেরর’ (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)। এই লড়াইয়ে দুটি দেশের ওপর সামরিক আগ্রাসন চলে, এবং আরও বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাদবাকি বিশ্বকে বদলে দেয়া সেই ৯/১১ হামলা নিয়ে কিছু বিষয় তাঁরা কখনোই জানতে পারবেন না। ঘটনার ২০ বছরেও যেসব প্রশ্নের কূল-কিনারা হয়নি, এমন ১১টি বিষয় তুলে ধরেছে বিশ্ব্যখ্যাত সাময়িকী রিডারস ডাইজেস্ট। এসব তত্ত্বের বিপরীতে চালু থাকা জনমতও তুলে দিয়েছেন ডাইজেস্টের সাংবাদিক লরেন কান।
এতটা দ্রুত কীভাবে ভেঙে পড়ল টাওয়ার দুটি?
তত্ত্ব : বাণিজ্যিক ফ্লাইটের আঘাতেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে—এমনভাবেই টুইন টাওয়ারের নকশা করেছিলেন প্রকৌশলীরা। তার পরও আঘাতের দুই ঘণ্টার মধ্যে টাওয়ার দুটি ধসে পড়ল। তাহলে কি আগে থেকেই টাওয়ার দুটির ভেতরে বিস্ফোরক মজুদ ছিল?
ব্যাখ্যা : বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন এটি বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। সর্বোচ্চ প্রকৌশলবিদ্যার ব্যবহারে গড়ে তোলা দুটি টাওয়ার এতটা দ্রুত ভেঙে পড়ার কথা নয়। বিশ্ববাসী হয়তো এর বিস্তারিত জানতেও পারবে না। এসব কারণে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সত্য মনে হয়।
তবে কি প্লেনের গায়ের অ্যালুমিনিয়াম ভূমিকা রেখেছিল?
তত্ত্ব : উড়োজাহাজের বডি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় অ্যালুমিনিয়াম। যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন স্মিথসোনিয়ান চ্যানেলে দুজন বিজ্ঞানী বলেন, ব্যাপক তাপমাত্রায় অর্থাৎ এক হাজার ফারেনহাইটের বেশি তাপে অ্যালুমিনিয়াম পানির স্পর্শ পেলে ক্ষমতাশালী বিস্ফোরকে পরিণত হয়। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, অ্যালুমিনিয়াম গলে ভবনের পানিতে মিশে এক প্রকার ‘ফার্নেস’ তৈরি হয়ে দ্রুততার সঙ্গে এর ধস ত্বরান্বিত করেছে।
ব্যাখ্যা : টাওয়ার দুটি জায়গায় দাঁড়িয়ে যেভাবে ভেতর থেকে ধসে পড়ে, সে বিবেচনায় এমন ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়নি আজও।
তাহলে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে অ্যালুমিনিয়ামের কথা নেই কেন?
তত্ত্ব : স্মিথসোনিয়ান চ্যানেল প্রশ্ন তোলে, তদন্ত প্রতিবেদনে টুইন টাওয়ারে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ বা অ্যালুমিনিয়ামের কথা উল্লেখ করা হয়নি কেন?
ব্যাখ্যা : তদন্তকারীরা হয়তো প্লেনের গলিত অবস্থায় অ্যালুমিনিয়াম চিহ্নিত করতে পারেনি অথবা এটিকে গুরুত্ব দেননি।
সরকার আগাম সতর্কতা এড়িয়ে গেল কেন?
তত্ত্ব : ৯/১১ হামলার আগের দিন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) চ্যানেলে দুটি বার্তা আসে। দুটিই আফগানিস্তান থেকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। একটিতে বলা হয়, ‘আগামীকাল জিরো আওয়ার’, অন্যটিতে বলা হয়, ‘খেলা শুরু আগামীকাল।’ মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএনের মতে, ১২ সেপ্টেম্বরের আগে বার্তা দুটি পড়াই হয়নি। এর পেছনে কারণ কী?
ব্যাখ্যা : এটা এখনো রহস্যময়। এর কোনো সদুত্তর মেলেনি।
১০ সেপ্টেম্বর কোথায় ছিল এনএসএ?
তত্ত্ব : দুটি ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পেয়েও কেন ১০ সেপ্টেম্বর এনএসএ কোনো উদ্যোগ নিল না? এখনো প্রশ্ন ওঠে, সেদিন কী করছিল এনএসএ?
ব্যাখ্যা : এনএসএ সেদিন কেন যে বার্তা দুটি খুলে দেখেনি তা আজও জানা যায়নি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপর গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ২৩ আগস্টের পর থেকে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে ছিল।
মার্কিন সরকার কখন জানতে পেরেছিল?
তত্ত্ব : ২০০১ সালের ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বিমান সংস্থাগুলোকে সতর্কতা দেয় যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরা পরিকল্পনা করছে এবং হাইজ্যাকের প্রশিক্ষণও নিচ্ছে বলে খবর রয়েছে। তবে সিএনএন জানায়, ওই সতর্কতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও এমন সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা : ১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেনের হুমকিমূলক বক্তব্যের পর এফএএ যুক্তরাষ্ট্রের বিমান সংস্থাগুলোকে উচ্চতর সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছিল।
কেউ সতর্ক করল না, কারণ কী?
তত্ত্ব : আল-কায়েদা বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করছে এমন তথ্য ২০০১ সালের ৬ আগস্ট তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে জানিয়েছিল সিআইএ। এ তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের সব দূতাবাস ও বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও জানায় সিআইএ। কিন্তু আমেরিকানদের জানানো হয়নি। এর কারণই বা কী তা জানার উপায় নেই।
ব্যাখ্যা : মার্কিন সরকার বার্তাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করেন, বিশেষ করে ৯/১১ হামলায় হতাহতদের পরিজনরা মনে করেন, সতর্কবার্তাটি সবাইকে জানানো দরকার ছিল। কেন যে গুরুত্ব দেওয়া হলো না, তা সবার অজানাই রয়ে গেল।
সরকারের নীতিমালায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?
তত্ত্ব : ২০২০ সালের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘লাইফসেভিং’ নামে নতুন একটি আইন করেছে। ওই আইন অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসী হামলার সতর্কবার্তা বাধ্যতামূলকভাবে নাগরিকদের জানাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন আদৌ এমন কিছু করবে কি?
ব্যাখ্যা : ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে আরো তৎপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ‘ন্যাশনাল টেররিজম অ্যাডভাইজরি’ সিস্টেম কাজ করছে। ফোন কোম্পানিগুলোও ভোক্তাদের জন্য সতর্কতার খবর থাকলে, তা জানিয়ে থাকে।
এফবিআইকে কেউ কিছু বলল না কেন?
তত্ত্ব : ৯/১১ হামলা নিয়ে সবচেয়ে সন্দেহজনক ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি হচ্ছে, সিআইএ কেন সেদিন এফবিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এফবিআইয়ের সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজউইককে বলেন, ‘এটা ভয়াবহ। এখনো আমরা জানি না, কেন এটি করা হয়েছিল।’
ব্যাখ্যা : আদতে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার দিন সিআইএ এমনটি কেন করেছিল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার সময়ও এ ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল।
সৌদি সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল?
তত্ত্ব : ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়াচডগ ডিডনট বার্ক : দ্য সিআইএ, এনএসএ অ্যান্ড ক্রাইমস অব ওয়ার অ্যান্ড টেরর’ বইতে এর দুই লেখক রে নওয়োসিয়েলস্কি ও জন ডাফি ৯/১১ হামলার ঘটনায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবতারণা করেন।
ব্যাখ্যা : ঘটনার ১৯ বছর পরে এসে যখন আমরা এসব জিজ্ঞেস করছি, তাতে বোঝা যায় সেদিন আসলেই কী কারণে, কী ঘটেছিল- তা জানা সত্যিই দুষ্কর।
আবারও কি এমন হামলা হতে পারে?
তত্ত্ব : ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ২০ বছরে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি করা হয়ে থাকে তা হলো— আবারও এমন হামলা হতে পারে কি না। বহু বিমানবন্দর তাদের প্লেন ছিনতাই ঠেকাতে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাতে বলা যায় আর এমনটি ঘটার আশঙ্কা নেই।
ব্যাখ্যা : তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যদি নিজেদের একেবারে নিরাপদ ভাবতে থাকি। এবিসি নিউজ বলছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো আত্মতৃপ্তিতে ভোগার ব্যাপারটি। সরকারি কর্মকর্তা, বিমান সংস্থাগুলো যদি নিজেদের নিরাপদ ভাবতে থাকেন, সেটি অবশ্যই দুশ্চিন্তার বিষয়।