এমানুয়েল মাখোঁর বিজয়


ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন লড়াইটা বেশ জমে ওঠেছিলো উদারপন্থী বনাম কট্টর ডানপন্থীর মধ্যে। জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়লেও সেই লড়াইয়ে জিতলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ফ্রান্সের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হলো কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদ মারিন ল্য পেনের। ফরাসি জনগণ শেষ পর্যন্ত মন্দের ভালো হিসেবে বেছে নিলো বর্তমান প্রেসিডেন্টকেই। এমানুয়েল মাখোঁ তৃতীয় ব্যক্তি যিনি টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসলেন। ১৯৮৮ সালে ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ ও ২০০২ সালে জ্যাক শিরাক দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন শার্ল দ্য গলকিন্তু প্রথম মেয়াদে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন না।

ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দৃষ্টি ছিলো পুরো বিশ্বের। চূড়ান্ত ভোটে এমানুয়েল মাখোঁ ভোট পেয়েছেন ৫৮. শতাংশ অপরদিকে মারিন ল্য পেন পেয়েছেন ৪১. শতাংশ।

ফ্রান্সে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ফরাসি সংবিধানে ১৯৬২ সাল থেকে দুটি ব্যালটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়ার বিষয়টি কার্যকর করা হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। এবার মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল কোটি ৮৭ লাখ। আর ভোট দিয়েছেন ৬৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোটার। এন ম্যারশে বা এগিয়ে যাও দলটির নেতা এমানুয়েল মাখোঁ ২০১৭ সালের মে থেকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত আছেন। পাঁচ বছর আগেও রান অফ নির্বাচনে একই প্রার্থী অতি ডানপন্থী ন্যাশনাল বা সাবেক ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের প্রধান মারিন ল্য পেনকে পরাজিত করেছিলেন এবং মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গত ১০ এপ্রিল ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ৯৭ শতাংশ ভোটের মধ্যে মাখোঁ পান ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অপর দিকে মারিন ল্য পেন পেয়েছেন ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট। প্রথম পর্বে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীছিলেন ১২ জন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম পর্বের ভোটে শীর্ষ দুই প্রার্থী দ্বিতীয় দফার ভোটে অংশ নেন।

ম্যাখোঁপেন লড়াই নতুন নয়। এর আগে ২০১৭ সালের নির্বাচনেও এই দুই প্রার্থী লড়েছিলেন। তবে সেবারও শেষ হাসি হেসেছিলেন এমানুয়েল মাখোঁ। ফ্রান্সের ছয় দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস বদলে দিয়ে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর লড়াই বেশ জমে ওঠেছিল। এমানুয়েল মাখোঁ ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রথসচাইল্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং গ্রুপের নির্বাহী ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি অর্থ, শিল্প, নতুন প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে তিনি নিজে গঠন করেন রাজনৈতিক দল এন ম্যারশে। একই সালের আগষ্টে দলের প্রচারের জন্য মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন।

এদিকে মারিন ল্য পেন ১৯৯৮ সালে উত্তরাঞ্চলীয় নর্দ পাস দ্য সালাইস এবং ২০০৪ সালে প্যারিস অঞ্চলের আঞ্চলিক কাউন্সিলর ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১১ সাল থেকে ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১২ সাল এবং ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। মারিন ল্য পেনের ধমনিতে বইছে রাজনীতিবিদের রক্ত। তাঁর বাবা জ্যঁ মেরি ল্য পেন এফএনের প্রধান ছিলেন। ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন তিনি। প্রথম দফায় উতরে গেলেও দ্বিতীয় দফায় পরাজিত হন জ্যাক শিরাকের কাছে। ল্য পেনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কয়েক দশকের।

নীতিগতভাবে এই দুই প্রার্থী দুই মেরুর বাসিন্দা। ল্য পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকতে আগ্রহী নন। পেনের ইইউবিরোধিতা সর্বজনবিদিতযাকে বলেইউরোস্কেপটিকবাইউরোসংশয়বাদী ব্রিটেনের মতো গণভোট করে ইইউ ছাড়তে চান তিনি। মাখোঁ দেখতে চান আরো শক্তিশালী ইউরোজোন। ল্য পেন ইউরো মুদ্রার ইতি টানতে চান। মাখোঁ গোটা জোনেই ইউরোকে শক্তিশালী করতে চান। ভোটের প্রচারের সময় এমানুয়েল মাখোঁ নিজেকে ইউরোপের সংহতির জন্য বড় শক্তি হিসাবে তুলে ধরেছেন। কোভিড ১৯ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার প্রসঙ্গের প্রতি বেশ জোর দেন তিনি। বামপন্থিদের ভোট নিজের দখলে নিতে ভোটের আগে ফ্রান্সের পেনশন ব্যবস্থাকে লঘু করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন মাখোঁ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মারিন ল্য পেন জিতলে ইউরোপের রাজনীতিতে বেশ বড় ধরণের অদলবদল হতে পারে। ল্য পেনের দলের বিরুদ্ধে বারবার বর্ণবাদ, ইহুদিবিদ্বেষ, ইসলামবিরোধিতার অভিযোগ উঠেছে। তবে গত কয়েক মাসের নির্বাচনী প্রচারের সময় দলের কট্টরপন্থি মনোভাব থেকে কিছুটা সরে আসা এবং অভিবাসন নিয়ে সুর কিছুটা হলেও নরম করার কারণে লড়াইটা বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন ল্য পেন। নির্বাচনে পরাজয় ঘটলেও নিয়ে তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়া ৫৩ বছর বয়সী মারিন ল্য পেন যে সহসাই রাজনৈতিক মঞ্চ ছাড়ছেন না তা নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর প্যারিসে তাঁর সমর্থকদের জানিয়েছেন, তিনি ফ্রান্সের জন্য, ফরাসি নাগরিকদের জন্য সর্বদা কাজ করে যাবেন।

২০ এপ্রিল এমানুয়েল মাখোঁ ল্য পেনের মধ্য টেলিভিশন বিতর্ক বেশ জমে ওঠে। বিতর্কের মূল বিষয়গুলো ছিল, পেনের সঙ্গে পুতিনের সান্নিধ্য, ইইউ পার্লামেন্টের বরাদ্দকৃত অর্থ জালিয়াতি, ইইউ নিয়ে অবস্থান ইউরোপের ভবিষ্যৎ, ফরাসি সংস্কৃতির খোলসে ইসলাম অভিবাসী বিরোধিতা, হিজাববিতর্ক, জ্বালানি, জীবনযাত্রার ব্যয়, পেনশন নীতি প্রভৃতি।

বিজয়ের পর প্রথম ভাষণে এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, আমি দেশের সবার প্রেসিডেন্ট। আমাদেরকে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। নারী এবং পুরুষের মধ্যে সমতা সমাজ গঠনের জন্য কাজ করবো। আমাদের দেশ খুব বেশি বিভক্ত। তাই প্রয়োজন শ্রদ্ধা প্রদর্শন।নতুন বছরের মেয়াদ হবে একটি নতুন যুগ। ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা এক বিয়োগান্তক সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমি কোনো একটি শিবিরের প্রেসিডেন্ট নই। আমি সবার প্রেসিডেন্ট।

নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে ৫৩ বছর বয়সী মারিন ল্য পেন বলেন, ‘আমরা যে আদর্শ নিয়ে কাজ করছি তা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।তিনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন আগামী জুনে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে মাখোঁর বিরুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেবেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে এমানুয়েল মাখোঁর দায়িত্ব পালন মোটেও সুখের হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁর নেওয়া ব্যবসায়ীপন্থী নানা পরিকল্পনার জেরে বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। ছাড়া সামনের দিনগুলোতে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিজের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে জুনে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করা। প্রথম মেয়াদের পাঁচ বছরের শাসনে প্রচুর উত্থানপতন হয়েছে। ইয়েলোভেস্ট মুভমেন্ট কিংবা তার ব্যবসায়ীপন্থি নীতি বড়লোকদের কর কম করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে। এই মেয়াদে তিনি কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন তা দেখার অপেক্ষায় ফ্রান্সের জনগণ। মাখোঁর জয়ের পর প্যারিসে বিক্ষোভ করেছে অধিকাংশ তরুণ। বিশ্ব রাজনীতির নানা রকমের বাঁক সহ অভ্যন্তরীণ অজস্র বিষয় এই মেয়াদে সামাল দিতে এমানুয়েল মাখোঁকে হিমশিম খেতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদিকে ১৯৬৯ সালের পর বছর ভোটার উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে কম। কোনো কারণে ভোটারদের একটা অংশ মাখোঁ অথবা পেন, কাউকেই পছন্দ করেননি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *