জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি বলেছেন, দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট চলছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সরকারের অধিক হারে ঋণ গ্রহণ। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট ঋণ পাচ্ছেন না।
বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সমস্যা হচ্ছে। এ অবস্থায় ঘাটতি মেটাতে সরকার যখন আবার ব্যাংক ঋণের সাহায্য নেবে, তা বিরাজমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। তিনি বলেন, দেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট বেকার সমস্যা। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে বাধা হয়- এ ধরনের পদক্ষেপ পরিহার করতে হবে।
শনিবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় রজনীগন্ধায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করে, গণমানুষের জন্যই বাজেট প্রণয়ন করা হয়। প্রস্তাবিত ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড়। আকৃতি বেশ বড়। বড় অঙ্কের অর্থ রাজস্ব খাতে আয় করতে হবে। আবার নির্ধারিত খাতে বড় ধরনের ব্যয়ও করতে হবে। আয় ও ব্যয় দুটির লক্ষ্য অর্জন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আয়ের প্রশ্নে আমরা চাই, অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন লোকদের কাছ থেকে বেশি হারে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা ও স্বল্প আয়ের মানুষের ঘাড়ে কম দায় চাপানো হোক। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর যেমন আয়কর থেকে যতদূর সম্ভব রাজস্ব আদায় হোক এবং পরোক্ষ কর (যেমন আমদানি শুল্ক ইত্যাদি) থেকে কম অংশ আয়ের ব্যবস্থা করা হোক।
তিনি বলেন, সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট মোট রাজস্ব আয়ের (৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি) মধ্যে আয়কর ৩৫%, মূল্য সংযোজন কর ৩৭.৮% (এটিকেও প্রত্যক্ষ কর বলা যায়), আমদানি শুল্ক ২৭.২% প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে সংশয় আছে। আয়কর থেকে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে এবং যে পদ্ধতির মাধ্যমে করা কথা বলা হয়েছে, তা বর্তমান আয়কর বিভাগের অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও লোকবলের কারণে প্রায় অসম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফলে আয়কর থেকে মোট আদায়ের যে অংশ আশা করা হচ্ছে, তা থেকে অনেক কম আয় হবে বলে অশঙ্কা আছে। একই কথা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জিএম কাদের বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে একটি বিশাল ফারাক আছে, যা বাজেট ঘাটতি ও টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ (৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি), বিদেশি ঋণ (৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি), ব্যাংকের বাইরে (সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) থেকে (২৭ হাজার কোটি) ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের ঋণের খরচ অধিক ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ ধরনের ঋণ গ্রহণের আগে বিষয়টি ভালো মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া মোট ঘাটতি আরও অধিক হওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে অর্থাৎ ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, তা পূর্ববর্তী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চেয়ে প্রায় ১৬%-এর অধিক। এ লক্ষ্যমাত্রা হয়তো অর্জন সম্ভব, তবে না হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জিএম কাদের বলেন, আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় ঘাটতি বাজেটের সমস্যা হল, ‘যত বেশি ঘাটতি, তত বেশি সংশোধন।’ ফলে সংশোধনের পর বাজেটের মূল চরিত্র আর রক্ষা করা যায় না। সংসদে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর দেশব্যাপী আলাপ-আলোচনা ও মতামত দেয়া এবং গ্রহণের ফলে যে বাজেট গৃহীত হয়, বাস্তবায়নকালীন সংশোধনের ধাক্কায় তার উদ্দেশ্য ও অনুমোদিত রূপরেখার ব্যাপক পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে অনেকেই বাজেটের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতি, ক্যান্সারের ওষুধ, রুটি-বিস্কুট যেসব পণ্যের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। অন্যদিকে নতুন কর আরোপ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- চিনি, ভোজ্য তেল, গুঁড়ো দুধ, তৈজসপত্রের দাম না বাড়ানোর প্রস্তাব করছি। আমরা মনে করি, কৃষক এদেশের প্রাণ। তাদের বাঁচানোর জন্য ধান ক্রয়ের প্রণোদনা এ বাজেটে থাকা দরকার। মোবাইল ফোন এখন আর কোনো বিলাসিতার পণ্য নয়। এটা এখন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। আইসিটি সেক্টরে ব্যবহৃত আইটেমগুলোর কর বৃদ্ধির পুনঃবিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
জিএম কাদের বলেন, যুবকদের মধ্যে সব ধরনের ব্যবসা, উদ্যোগ সৃষ্টির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে সংশোধনীতে হতদরিদ্র, তরুণ ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বরাদ্দ যেন কাটছাঁট না হয়। আমরা ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করে কমপক্ষে এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রদানের আহ্বান করছি।
এ সময় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি বলেন, প্রবাসীদের প্রণোদনা দেয়ায় রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাবে। কৃষককে লাভবান করতে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে এলে হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তিনি বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কর্মসংস্থান এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে ড্রাইভিং শেখাতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জাতীয় পার্টির মহাসচিব।