প্লাস্টিক দানা ঘোষণা দিয়ে ৩০ কনটেইনার বোঝাই সিমেন্ট নিয়ে এসেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। এতে প্রাথমিকভাবে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জালিয়াতির এ ঘটনায় কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মলিউজ্জামান সজিব বাদী হয়ে মামলা করেছেন।
তবে এ চালানের বিপরীতে অর্থ পাচার হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, এ চালানে আসলে সিমেন্ট না অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে আসা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রাণ গ্রুপের এ প্রতারণায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের ক্যাব নেতা নাজের হোসাইন। তিনি বলেছেন, এটা ভোক্তাদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে এ জালিয়াতির বিচার হওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র বলছে, প্রাণ-আরএফএলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরি লিমিটেড প্লাস্টিক দানা ঘোষণা দিয়ে ৫১০ টন পণ্য নিয়ে আসে দুবাই থেকে। গত ২৬ মে চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।
গত ৬ জুন রাতে ঈদের ছুটি চলাকালে অনেকটা গোপনে চালানটি খালাসের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পণ্যের কায়িক পরীক্ষাকালে দেখা যায়, পণ্যের বস্তায় লেখা আছে সিমেন্ট। সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ায় চালানটি আটকে দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। প্রাণ গ্রুপের সব অপচেষ্টা ভেস্তে যায়।
শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার রাতে বন্দরের এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) ইয়ার্ডে ৩০টি কনটেইনার খোলার পর ১০ হাজার ২৫০ বস্তা সিমেন্ট পাওয়া যায়। সূত্র জানায়, ঘোষিত প্লাস্টিক দানার শুল্ক ৩২ শতাংশ।
আর সিমেন্টের শুল্ক ৯১ শতাংশ। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক দানা হিসেবে পণ্যের শুল্ক পরিশোধ করে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রাপ্ত পণ্য-সিমেন্টের শুল্ক আসে প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এই হিসাবে চালানটিতে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ড যুগান্তরকে বলেন, প্রাণ ডেইরি লিমিটেড দুবাই থেকে চালানটি নিয়ে আসে। তারা ৫ লাখ ৬৬ হাজার ডলার মূল্যের ৫১০ টন প্লাস্টিক দানা আনার ঘোষণা দেয়। তাদের নিজস্ব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এই চালান ছাড়ের জন্য কাস্টমসে ডকুমেন্ট জমা দেয়। পণ্য পরীক্ষার সময় দেখা যায় বস্তার গায়ে সিমেন্ট লেখা রয়েছে। এতে মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি ধরা পড়ে। প্লাস্টিক দানা ঘোষণা দিয়ে সৌদি আরবের জেবেল আলী গ্রুপের উন্নতমানের সিমেন্ট আনা হয় বলে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়ে ৩০ কনটেইনার পণ্য জব্দ করে সিলগালা করে দিয়েছি। চালানটি আসলে সিমেন্ট কি না, তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এর নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টে পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে এই ৩০টি কনটেইনারে আসা পণ্য চালানটিতে সিমেন্টের বাইরে অন্য কোনো পণ্য আছে কি না, সেগুলো তদন্ত করে দেখব এবং শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হবে। আপাতত ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকির মামলা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যদি এ চালানে অর্থ পাচার কিংবা অন্য কোনো পণ্য আনার ঘটনা ধরা পড়ে তবে পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র জানায়, সাধারণত এ ধরনের চালান ধরা পড়লে ফাঁকি দেয়া শুল্ক আদায়ের পাশাপাশি মিথ্যা ঘোষণার জন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। এই কোম্পানি এর আগে মিথ্যা ঘোষণায় কোনো পণ্য এনেছিল কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি তাদের সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপরও নজর রাখবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, এই চালান আমদানির বিপরীতে বিদেশে অর্থ পাচার হতে পারে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। সাধারণত বেশি মূল্যের পণ্য আনার ঘোষণা দিয়ে কম মূল্যের পণ্য নিয়ে এলে সে ক্ষেত্রে অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়।
প্রাণ ডেইরির আমদানি করা চালানটির ঘোষিত প্লাস্টিক দানার মূল্য যদি আমদানিকৃত সিমেন্টের মূল্যের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে অর্থ পাচারের বিষয়টি সামনে আসবে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে সিমেন্টের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
অর্থ পাচার কিংবা শুল্ক ফাঁকি দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যেই যে প্রাণ গ্রুপ মিথ্যা ঘোষণায় এই চালান এনেছে তা অনেকটা নিশ্চিত। ঈদের ছুটিতে সাধারণত কড়াকড়ি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ঢিলেঢালা ভাব থাকে। ব্যস্ততার মধ্যেই অর্থাৎ ঈদের পরদিন ৬ জুন তড়িঘড়ি করে চালানটি ছাড় করে নিতে চেয়েছিল তারা।
ঈদের পর যেহেতু লোকজন কম থাকে, তাই সেই সময় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য নিয়ে যাওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। এ কারণে এবার ছুটিতে যেসব কনটেইনার খালাস হওয়ার কথা, সেগুলোর ওপর বাড়তি নজর রাখা হয়। প্রাণ গ্রুপ ঈদের ছুটির মধ্যেই পণ্যের চালানটি নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা বাড়তি সাবধানতার অংশ হিসেবে দুটি কনটেইনার চেক করে দেখেন তাতে সিমেন্ট রয়েছে। তখন পুরো চালানটিই আটকে দেয়া হয়।