আজ দেশে পালিত হচ্ছে শিশুশ্রম বিলোপ দিবস। জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি রাষ্ট্রেরই । কিন্তু আমাদের মতো অনেক দেশেই শিশুদের সেভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। কারণ যে কোমল হাতে বই-খাতা-কলম থাকার কথা, সেই হাতে আমরা তুলে দিচ্ছি শ্রমের হাতিয়ার। দেশে কমপক্ষে এক কোটি শিশু লেখাপড়া না করে জীবিকা নির্বাহের জন্য শ্রম দিচ্ছে ঘরে বাইরে, কলকারখানায় বিভিন্নভাবে। প্রতিদিনই বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। শিশুশ্রম বন্ধে আইন রয়েছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ সাক্ষরও করেছে। কিন্তু শিশুশ্রম বন্ধের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটেই আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিলোপ দিবস।
শিশু শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান নেই এদেশে। তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা চার কোটির ওপরে। এর মধ্যে কমপক্ষে এক কোটি শিশু কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে জড়িত। আর ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত ১৩ লাখের বেশি শিশু। শিশু শ্রমিকদের ৭০ ভাগই দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এই শিশুশ্রম শহরে আছে, গ্রামেও আছে। শহরের শিশুরা তিনশ’ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত। গ্রামের শিশুরা নিয়োজিত প্রায় দেড়শ ধরনের কাজে। এসব কাজের অনেকগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। এইসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে- ইলেকট্রিক, ওয়েল্ডিং, ট্রাক ও টেম্পুর হেলপার, চামড়া ও সাবান ফ্যাক্টরী, রাসায়নিক পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা, ঢালাই কারখানা, পুরনো ব্যাটারি ভাঙা, বিড়ি তৈরির কারখানা মাদকদ্রব্য বহন, গৃহভৃত্যের কাজ ইত্যাদি। এইসব কাজ শিশুদের শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া, শিশু শ্রমিকের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। দিনে ১২ থেকে ১৫ ঘন্টাই কাজ করতে হয় তাদের। বিশ্রাম ও বিনোদনের সুযোগও পায় না তারা।
আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এই শিশুরা এভাবে অবজ্ঞা আর অনাদরে বেড়ে উঠছে শুধুমাত্র দারিদ্র্য, অসচেতনতা, আর সরকারের অদূরদর্শিতার জন্য। এখানে লাখ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে চরম দারিদ্র্য পীড়িত ঘরে। আবার কারও জন্ম হচ্ছে পথে-ফুটপাতে। এদের অনেকেই বেড়ে উঠছে অভিভাবকহীন অবস্থায়। এদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকা তথা জীবন জীবিকার সন্ধানে উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা লেখাপড়ার কথা চিন্তাই করতে পারে না। বিশেষ করে এই ছিন্নমূল শিশুদের খাওয়া পরা, বাসস্থান, কিংবা শিক্ষার সুযোগটুকু করে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা, ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। অনেক সময় দেখা যায়, এই ধরনের শিশুর অভিভাবকরাই তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের পেশায় শ্রম দিতে উদ্বুদ্ধ করছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর বর্ণবৈষম্যই শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে শ্রম বাজারে। আর ধ্বংস হচ্ছে আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দুইশ ২০ মিলিয়ন। ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিলো দু’শ ৪৬ মিলিয়ন। তার মানে, সারা বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। অথচ বাড়ছে আমাদের দেশে। যে কারণে শিশুশ্রম বিলোপে আমাদের সচেতন হতে হবে সবচেয়ে বেশি। এজন্য প্রথমে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর জোর দিতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে একটি সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। এটা পুরোপুরি কার্যকর হলে শিশুদের জন্য অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুশ্রম নিরসনে একটা জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া শিশু শ্রমিকদের স্বস্ব কাজে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার ওপর জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে অভিভাবকসহ সকলকে। মধ্যম আয়ের দেশ এ পরিণত হয়েছি আমরা। এই অর্জনকে টেকসই করার পেছনে শিশু শ্রম একটা বিরাট অন্তরায় নিঃসন্দেহে।