এক সময়ের বৃহত্তর সিলেটের শস্যভান্ডর খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলার প্রধান দুঃখ খরস্রোতা ধলাই নদী। এ নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হতে যাচ্ছে অনেক ঘরবাড়ি। ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের ৬টি পরিবার।
এই ছয়টি পরিবার পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মোরগের খামারে ঠাই নিয়ে কোনমতে দিন কাটছে। তাদের পুণর্বাসনে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে ভাঙ্গনকৃত স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৌলভীবাজার এর তত্ত্বাবধানে ২টি বাঁধে মাটির কাজ চলছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জ পৌরসভার রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দেয়। একদিনের ব্যবধানে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পুণরায় একই গ্রামে নতুন করে আরও একটি ভাঙ্গন দেখা দেয়। এ ভাঙ্গনের ফলে রামপাশা গ্রামের জয়ধন মালাকার, যোগিন্দ্র মালাকার, মনিন্দ্র মালাকার, সুনীল মালাকার, সরজিনী দেবনাথ ও লাইলী বেগমের বসতঘর বিলীন হয়ে যায়।
এই ছয়টি পরিবার পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মোরগের খামারে ঠাই নিয়ে কোনমতে দিন কাটছে। চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নিখিল মালাকারের বসত ভিটে। আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা ত্রাণ চাই না। ব্লক দিয়ে নদীর স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চাই।
নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব মনিন্দ্র মালাকার জানান, আমাদের বসতবাড়ির মাটিটাও বন্যায় নিয়ে গেছে। এখন থাকার জায়গাটুকুও নেই। পার্শ্ববর্তী সৈয়দ শাহীন মিয়ার মোরগের খামারে থাকিয়া কোন রকম দিন কাটারাম। কই যাইমু, কই থাকমু কোন হিসাব পারাম না। শ্রমজীবি এসব পরিবারের কেউ কাঠমিস্ত্রি, দিনমজুর, টেইলারি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তাদের আয়ের পথ বন্ধ। নদীর ভাঙ্গন ওই গ্রামের দু’টি ভৈরব থলি ও একটি দুর্গাবাড়ি বিলীন করে গেছে। গত এক দশকে গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রায় দু’শ কিয়ার জমি নদীর বিপরীত পাশে চলে গেলেও সেখানে তাদের আর অধিকার নেই। অন্যেরা সেসব স্থান নিজেদের দখলে নিচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণের পরিবর্তে পুণবার্সন ও নদীর সংস্কার কাজে বাঁক কেটে গতিপথ সোজা করে এবং মজবুত প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
রামপাশা গ্রামের জয়ধন মালাকার বলেন, নদী আমাদের সবকিছু নিয়ে গেছে। সন্তানাদি নিয়ে রামপাশা বালিকা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছি। যোগিন্দ্র মালাকার বলেন, গ্রামের সৈয়দ আব্দুর রহিম এর একচালা টিনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব হওয়া সুনীল মালাকার, লাইলী বেগম ও মনিন্দ্র মালাকার বলেন, ‘নদীর ভাঙ্গনে আমাদের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। এখন মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও নেই। বন্যার এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা কিছু ত্রাণ ও কিছু চাল ছাড়া আর কিছুই পাইনি। আয় রোজগারও করতে পারছি না। ফলে অভাব অনটনে দিনযাপন করছি।’
ঢলের প্রবল স্রোতে ঘর ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রত্না পাল বলেন, ‘স্বামী নেই। নিজে টেইলারি করে সংসার চালাই। ঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন পার্শ্ববর্তী নির্মল পাল চৌধুরীর ঘরে আছি। এক ছেলে মাস্টার্স পড়লেও এখন তার পড়ার টেবিলটাও নেই। কিভাবে যে দিন কাটাবো ভেবে পাচ্ছি না।’
কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাসেল মতলিব তরফদার নদী ভাঙ্গন ও বন্যায় ৬টি পরিবার বিলীন ও ক্ষতিগ্রস্ত ১২০টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১৫০টি পরিবারের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রামপাশার ওই এলাকায় গত ২৫ বছর ধরে শুধুমাত্র ২৫টি শব্দকর পরিবারই সম্পূর্ণরুপে বিলীন হয়ে গেছে। তারা এই পরিবারগুলো কোথায় গেছে বা কোথায় আছে তার কোন হদিস নেই।
কমলগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র মো. জুয়েল আহমদ বলেন, নদী ভাঙ্গন ও বন্যার সাথে সাথেই আমরা দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ত্রাণ ও নিজেদের পক্ষ থেকে ত্রাণ, চাল ছাড়াও সরকারিভাবে আসা চাল বিতরণ করেছি। এ বিষয়ে ইউএনও’র কাছে দাবি জানিয়েছি তাদের দ্রুত ঘর করে দেওয়ার জন্য। তাছাড়া যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সহায়তা প্রদানের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, নদী ভাঙ্গনে বিলীন হওয়া ও বন্যায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরী করা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে এসব ব্যক্তিদের ঘর করে দেওয়ার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি এবং পরিপূর্ণ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।