স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী করে ডেঙ্গু নিয়ে হাই কোর্ট


এডিসসহ মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশন ও সরকারের ব্যর্থতায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাই কোর্ট। মঙ্গলবার এক শুনানিকালে সিটি করপোরেশনের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে একজন বিচারক বলেছেন, “আজকে দেখলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (ডিএস) উপসচিবের স্ত্রী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী করে? নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার স্ত্রী মারা যায়, তারা জেগে ঘুমালে আমরা তো তাদের তুলতে পারব না।”

সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ‘ধাক্কাধাক্কিতে’ কাজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন ওই বিচারপতি। এখন বাংলাদেশে মশা মারবে কে, সে প্রশ্নও করেছেন এই বিচারপতি।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমে শিথিলতার অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ দিচ্ছে তা কার্যকর নয় বলে আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ আনতে কত দিন লাগবে, তা গত ২৫ জুলাই জানতে চেয়েছিলেন হাই কোর্ট। তখন সময় নিয়ে মঙ্গলবারও সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারেনি সিটি করপোরেশন ও রাষ্ট্রপক্ষ।

আদালত মঙ্গলবারের আদেশে মশা মারার যথাযথ ওষুধ আনতে কত সময় লাগবে, তা বৃহস্পতিবারের দুপুরের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে। দুই সিটি করপোরেশন ও রাষ্ট্রপক্ষকে সুনির্দিষ্টভাবে তা হলফনামা আকারে জানাতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বিত কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করার পর বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।

আদালতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৌফিক ইনাম টিপু এবং দক্ষিণ সিট করপোরেশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়েরা ফায়রোজ।

সিটি করপোরেশেনের এ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন তোলে আদালত।

শুনানিতে আদালত নতুন ওষুধ আনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, গত ২৭ জুলাই কাউন্সিলরদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পরমাণু শক্তি কমিশনে এ বিষয়ে একটি সভা হয়েছে। আরও অধিকতর কার্যকর কীটনাশক কীভাবে দেওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “আরও অধিকতর কার্যকর লাগবে কেন, যেটা আছে সেটা কাজ করছে না?”

আইনজীবী বলেন, “কাজ হচ্ছে। কৃষি গবেষণাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ওষুধকে কার্যকর বলেছে।”

তখন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক মো. সোহরাওয়ার্দী বলেন, “সরকার তো বলছে, কার্যকর ওষুধ ছিটানোর কথা। যদি কার্যকর ওষুধই হবে তাহলে সরকার কেন বলছে?”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক তারিক-উল হাকিম বলেন, “এই যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এটা কী কারণে হয়েছে?”

আইনজীবী বলেন, “কার্যক্রম তো চলছেই। আপনারা রুল জারির পর গতি বেড়েছে। কাজ হচ্ছে, কয়েক দিন সময় লাগবে।”

বিচারক তখন বলেন, “আমার তো মনে হয় না। আমার বাসার এলাকায় ওষুধ ছিটাতে আসেনি। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আপনারা এই জিনিসটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না, আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে আপনাদের সতর্ক করা হয়েছিল। আপনারা উদ্যোগ নিলেন না কেন?”

আইনজীবী বলেন, “ওই সময় থেকেই তো আমাদের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এখন প্রকোপ বেড়েছে।”

তখন কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, “ওই সময় থেকে উদ্যোগ নিয়ে থাকলে প্রকোপ বাড়ছে কেন? আপনাদের উচিৎ ছিল ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করার পর সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো।

“এগুলোর কিছুই হয়নি। হলে হয়ত এ পরিস্থিতি হত না। আমরা রুল দেওয়ার পর আপনাদের (সিটি করপোরেশনের) ঘুম ভাঙল। তখন কয়েক দিন উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন। এখন সরকার ধমক দিয়েছে, আপনারা চুপ করে গেছেন।”

এ পর্যায়ে আইনজীবী বলেন, “আমরা তো সরাসরি ওষুধ আনতে পারব না। চীন থেকে এ ওষুধ আনা হবে। তার জন্য রেজিস্ট্রেশন লাগবে। ওষুধ আনতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।”

তখন বিচারপতি তারিক-উল হাকিম বলেন, “সবাই জানে অকার্যকর ওষুধ দিচ্ছেন। এখন স্টেটমেন্ট দেন কতদিনের মধ্যে আনতে পারবেন।

“আজকে দেখলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (ডিএস) উপসচিবের স্ত্রী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী করে? নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার স্ত্রী মারা যায়, তারা জেগে ঘুমালে আমরা তো তাদের তুলতে পারব না।

“সিটি করপোরেশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ধাক্কাধাক্কি করে কিছুই হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশের মশা কে মারবে?”

ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহী অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধে এডিসসহ মশা নির্মূলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে গত ১৪ জুলাই নির্দেশ দেন আদালত। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও এডিস মশা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন নজরে আসার পর সেদিন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত রুলসহ এই আদেশ দেন। তার ধারাবাহিকতায় গত ২৫ জুলাই আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

আদালত ওই দিন জানতে চান, কত দিনের মধ্যে মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ আনা হবে। সেদিন দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, মশা নিধনে তারা সমন্বিতভাবে চারদিনের অভিযান চালাবেন। ওই অভিযানের পর এ বিষয়ে আদেশ দিলে ভালো হবে। তখন আদেশের জন্য মঙ্গলবার দিন রাখেন আদালত।

এদিন শুনানির শুরু হওয়ার সিটি করপোরেশনের আইনজীবীরা তাদের সমন্বিত ওই অভিযানের বিষয়ে বলতে শুরু করলে আদালত ‘কার্যকর’ ওষুধ আনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানতে চান। সূত্র: বিডিনিউজ।